• We kindly request chatzozo forum members to follow forum rules to avoid getting a temporary suspension. Do not use non-English languages in the International Sex Chat Discussion section. This section is mainly created for everyone who uses English as their communication language.

অদৃশ্য অতিথি

Bhoot

Epic Legend
Chat Pro User
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
 
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
শেষের ধাক্কাটা মন ছুঁয়ে গেল, গা ছমছমে ক্লাইম্যাক্স!
Awesome Intelligence
 
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
1000305986.gif
 
এমন টুইস্ট আশা করিনি একদম ! যে ভূত মানতো না, সে-ই শেষ পর্যন্ত ভূত হয়ে ফিরলো…দারুণ লিখেছো।
 
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
My god..... Ki likhecho tumi!!!! Osadharonnnn ♥️
 
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
ভাই অসাধারণ লিখেছিস
তবে আমার মনে হয় দুটো জায়গায় একটু সাসপেন্স যোগ করা যেতে পারতো আর, অমিত এর স্টেশন এর উপস্থিতি টা হঠাৎ করে চমকে দেওয়ার মতো করা যেতো আর, স্টেশন থেকে ভুতুড়ে বাড়ির পথে যাওয়ার সময় টোটো ভাড়া নেওয়ার একটা ব্যাপার অ্যাড করা যেতে পারতো ,
যেমন " টোটো চালক বলল মাথা পিছু ২০ টাকা করে লাগবে বাবু রা" কিন্তু নামার সময় ১০০ টাকার নোট দিতে সে ফিরত দিলো ৪০ টাকা, অথচ তারা ছিল টোটোতে ৪জন, রিয়াদ, বিপুল, শোভন আর অমিত। এই ব্যাপার টা পড়ে শোভন মনে মনে খুশি হয়ে ভাবে, " বাহ্ টোটো চালক টা বেশ বোকা তো, মাথা পিছু ২০ টাকা করে বলে ১৫ করে নিয়ে নিলো, দর দাম না করা তেই"

**** আর একটা জায়গায় ভুল হয়েছে একটু, শুধরে দিচ্ছি, ওরা যখন সিদ্ধান্ত নেয় স্টেশন এ ফিরে বাকি সময় কাটিয়ে সকলের ট্রেন ধরবে, তখন সময় টা মেনশন করা দরকার ছিল , ভোর রাত্রে টোটো পাওয়া সম্ভবত কঠিন একটু তাও আবার গ্রামে গঞ্জে।

অসাধারণ লিখেছিস @Bhoot , আমাকে বলেছিলি কেমন হয়েছে জানাতে , তাই ছোট ভাই হিসেবে একটু ফোড়ন কেটে দিলাম। ❤️
:clapping: :inlove::heart1::hearteyes:
 
ভাই অসাধারণ লিখেছিস
তবে আমার মনে হয় দুটো জায়গায় একটু সাসপেন্স যোগ করা যেতে পারতো আর, অমিত এর স্টেশন এর উপস্থিতি টা হঠাৎ করে চমকে দেওয়ার মতো করা যেতো আর, স্টেশন থেকে ভুতুড়ে বাড়ির পথে যাওয়ার সময় টোটো ভাড়া নেওয়ার একটা ব্যাপার অ্যাড করা যেতে পারতো ,
যেমন " টোটো চালক বলল মাথা পিছু ২০ টাকা করে লাগবে বাবু রা" কিন্তু নামার সময় ১০০ টাকার নোট দিতে সে ফিরত দিলো ৪০ টাকা, অথচ তারা ছিল টোটোতে ৪জন, রিয়াদ, বিপুল, শোভন আর অমিত। এই ব্যাপার টা পড়ে শোভন মনে মনে খুশি হয়ে ভাবে, " বাহ্ টোটো চালক টা বেশ বোকা তো, মাথা পিছু ২০ টাকা করে বলে ১৫ করে নিয়ে নিলো, দর দাম না করা তেই"

**** আর একটা জায়গায় ভুল হয়েছে একটু, শুধরে দিচ্ছি, ওরা যখন সিদ্ধান্ত নেয় স্টেশন এ ফিরে বাকি সময় কাটিয়ে সকলের ট্রেন ধরবে, তখন সময় টা মেনশন করা দরকার ছিল , ভোর রাত্রে টোটো পাওয়া সম্ভবত কঠিন একটু তাও আবার গ্রামে গঞ্জে।

অসাধারণ লিখেছিস @Bhoot , আমাকে বলেছিলি কেমন হয়েছে জানাতে , তাই ছোট ভাই হিসেবে একটু ফোড়ন কেটে দিলাম। ❤️
:clapping: :inlove::heart1::hearteyes:
প্রথম সাজেশান টা, আমি ইচ্ছে করেই ওখানে কোনো চমক রাখিনি, তার কারণ আমি পাঠক দের গেস করতে দিতে চাই নি, যে অমিত ই কিছু একটা হতে পারে, আর সেকেন্ড সাজেশান টা দারুন, ওটা আমি অ্যাড করে দেবো। ধন্যবাদ, গঠন মূলক আলোচনার জন্য। ❤️
 
প্রথম সাজেশান টা, আমি ইচ্ছে করেই ওখানে কোনো চমক রাখিনি, তার কারণ আমি পাঠক দের গেস করতে দিতে চাই নি, যে অমিত ই কিছু একটা হতে পারে, আর সেকেন্ড সাজেশান টা দারুন, ওটা আমি অ্যাড করে দেবো। ধন্যবাদ, গঠন মূলক আলোচনার জন্য। ❤️
আরো লিখতে থাক বড়ভাই❤️
 
"ভূত বলে কিছু নেই!" অমিতের গলা শুনে মনে হচ্ছিল ক্লাব রুমের পুরানো ফ্যানটাও যেন তার কথার সমর্থনে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। "এসব কুসংস্কার, বানোয়াট গল্প। বিজ্ঞানের যুগে এগুলো মানে কিভাবে তোরা?"

বাকি চার বন্ধু—রিয়াদ, তানিয়া, বিপুল, শোভন আর আমি —অমিতের দিকে তাকালাম বিরক্তি নিয়ে। রিয়াদ বলল, "অমিত, পৃথিবীতে অদৃশ্য, অজানা অনেক কিছুর অস্তিত্বই আমরা জানি না। সবটা কি অস্বীকার করবি?"

"যাকে প্রমাণ করা যায় না, তাকে আমি মানব না," অমিত কথা টা বলে একটা অহংকারী হাঁসি হাঁসলো। তানিয়া বললো, পৃথিবীতে এই বিজ্ঞানের যুগেও অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যেগুলো কে প্রমাণ করা যায়না, কিন্তু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কেও তো অস্বীকার করা যায় না। অমিত উত্তরে বলল, হতেও তো পারে, ওগুলো সব আমাদের মস্তিষ্কের ভুল, পঞ্চ ইন্দ্রিয় কে আমাদের মাথাই যে বোকা বানাচ্ছে না, তার কি প্রমাণ ? তানিয়া অমিত এর সাথে কথায় পেরে উঠলো না। বিপুল চুপ চাপ সব শুনছিল, বলল, দেখ ভাই, তর্ক করলে অনেক কথাই বাড়বে, আমি অত শত কিছু জানিনা, কোনো দিন তোর সঙ্গে কোনো ঘটনা ঘটলে তখন বুঝবি। অমিত ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, ও আমি দেখে নেবো। এই রকম তর্ক বিতর্কের মধ্যে দিয়েই আড্ডা শেষ হলো আজকের মতো।

আজকের সন্ধের আড্ডা টা চলছিল ইদানীং কালের রাজের অর্থনীতি নিয়ে, মাঝে কেউ কেউ কোনো কোনো বিশেষ দল কে খোঁচা দিতে ছাড়েনি। আজকে অমিত আসেনি, ব্যাটা, কোথায় ডুব মারলো? নাকি গোঁসা হয়েছে বাবুর ? শোভন বলল “তুই কিছু জানিস বিপুল?, তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়”. বিপুল মুখের আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলো সে জানে না। বাকিরা বলল, একবার ফোন করে দেখ না, কি খবর, স্পিকারে দে ফোন টাকে। বিপুল স্পিকারে দিয়ে অমিত এর নাম্বার ডায়াল করলো। ও প্রান্ত থেকে অমিত ফোন টা ধরেই বলে উঠলো, আরে ভাই, আমিই একটু পরে ফোন করে জানতাম, আমাকে আজকে দুপুরেই মামার বাড়িতে যেতে হলো, দিদার প্রেসার টা হঠাৎ বেড়ে দিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছিল। এখন কেমন আছেন উনি? বিপুল জিজ্ঞেস করলো, অমিত বলল – নাহ, চিন্তার কিছু নেই , এখন সুস্থই আছেন। তার পরে একটা দুটো এটা ওটা কথা হওয়ার পরে, অমিত বললো, এখানে কাছেই একটা অনেক দিনের পুরোনো মাটির দোতলা ফাঁকা বাড়ি আছে, আসবি নাকি ? এক রাত সবাই মিলে কাটানো যেতো। সবাই বলে ওতে নাকি ভূত থাকে, আমার বিশ্বাস তোদের কে আমি হাতে নাতে প্রমাণ দেখাতে পারবো যে ভূত বলে কিছু হয় না। পাশের থেকে রিয়াদ বলে উঠলো, আমি রাজি, কিন্তু ঠিকানা জানবো কি ভাবে ? অমিত বলল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তোরা কালকে দুপুরের ট্রেন ধরে চলে আয়, আমি স্টেশন এ গাড়ি নিয়ে চলে আসবো তোদের কে নিতে। সবাই মোটামুটি রাজি, শুধু তানিয়া যেতে পারবে না, কারণ তার বাড়ি থেকে ছাড়বে না। বাকিরা সবাই মিলে ঠিক হলো দুপুর ২ টার ট্রেন টা ধরলেই, সন্ধের আগে পৌঁছে যাবে।

ঠিক টাইমে সবাই স্টেশন এ এসে হাজির, শোভন একটা EMF মিটার নিয়েছে সাথে। ওটা দিয়ে নাকি ভূতের উপস্থিতি জানা যায়। EMF মিটার এর ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড এ কোনো ওয়েব এনার্জি এলে লাল বাতি জ্বলে আর সাথে বিপ সাউন্ড হয়। বাকি রা উৎসাহিত হয়ে জিনিস টা ট্রেন এর মধ্যেই দেখতে চাইল, শোভন মিটার টা বের করলো, সবাই একে একে হাতে নিয়ে দেখছে, হঠাৎ মিটার টাতে তিন বার মতো লাল লাইট আর বিপ সাউন্ড বেজে উঠলো। সবাই চাপা হাঁসি হাসছে, বলছে, কিরে শোভন ? ট্রেনেও কি ভূত আছে নাকি ? শোভন বলল না, ভূত নেই, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখ, ট্রেনের পেন্টগ্রাফ এর নিচেই বসে আছিস, হতেই পারে ওটার ইন্ডাকশান এফেক্ট। রিয়াদ বলল, কিন্তু এত দূর থেকে কিভাবে ইন্ডেকশান নিলো ? আর বিশেষ কোনো কথা হলো না এই নিয়ে। ট্রেন টা ঢুকতে লেট করলো, এখানেই সাড়ে ছটা বেজে গেলো। কিন্তু অমিত এর কোনো পাত্তা নেই। বিপুল ফোনে ট্রাই করলো, কিন্তু সুইচ অফ বলছে। সবাই চিন্তিত আর অধৈর্য হয়ে বলছে, অমিত টা একেবারে ইরেসপনসিবল। সাত টা বেজে গেলো এখনো ব্যাটার পাত্তা নেই। বিপুল আরেকবার ফোন করবে বলে বের করেছে, দূরে অমিত কে দেখতে পাওয়া গেলো। খুব ব্যস্ত হয়ে অমিত এগিয়ে আসছে, চুল গুলো অবিন্যস্ত, মুখ টা যেন ফ্যাকাশে, হন হন করে হেঁটে আসছে, একটা হাত ওপরে তুলে আমাদের দিকেই ইশারা করছে। আমি মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম, কিরে? অমিত, তোর এখন আসার সময় হলো ? আর তোর গাড়ি কই ? অমিত বলল, আর বলিস না ভাই, কি বিপদে যে পড়লাম! গাড়ি টা নিয়ে প্রবলেমে পড়েছি, এই গাড়ি কোনো দিন আমার প্রাণ টা নেবে, একটু গণ্ডগোল হয়ে গেছে ভাই, কিছু মনে করিস না, আমি অনেক টা হেঁটে হেঁটে আসছি। অমিত এসে আমাদের সবার মাঝে দাঁড়ালো। হঠাৎ করে শোভনের ব্যাগ এ থাকা EMF মিটার টা বাজতে শুরু করে দিলো। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে, অমিত জিজ্ঞেস করলো, কি বাজে ? বিপুল বলল EMF মিটার এনেছে শোভন ওটাই বাজছে, ট্রেন এও একবার বেজেছিল, তখন বন্ধ হয়ে গেছিল এখন আর বন্ধ হচ্ছে না। অমিত হালকা ঠাট্টার ছলে কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, শোভন ভূত দেখতে এসে কি শেষে আমাকেই ভূত বানাবে নাকি ? সবাই হেসে উঠলো, রিয়াদ বলল, খারাপ মিটার এনেছিস, ব্যাটারি খুলে ফেল, নাহলে আর বন্ধ হবে না। অমিত রিয়াদের কথার সমর্থন করলো। বাকি রাও বললাম, হ্যাঁ ভাই, বন্ধ করে দে, ভুল ভাল ইন্ডিকেশান দিচ্ছে। শোভন যেন কিছুই বুঝে না, অগত্যা ব্যাটারী ডিটাচ করে মিটার টার বাজার বন্ধ করলো। যেহেতু অমিত এর গাড়ি তে প্রবলেম হয়েছে, আনতে পারেনি, ঠিক হলো একটা টোটো রিজার্ভ করে যাব সবাই। কিছু টা হেঁটে যেতে সামনে একটা জটলা দেখতে পাওয়া গেলো, অনেক লোক জমেছে, কোনো কার এক্সিডেন্ট হয়েছে বোধ হয়, আমরা ভাবলাম একবার গিয়ে দেখে আসি, কিন্তু অমিত বাধ সাধলো, বলল, এমনিই দেরি হয়ে গেছে, ওসব দেখে আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না, আমি এমনিতেই বড় ক্লান্ত। অগত্যা, ওদিকে না গিয়ে এগিয়ে চললাম।

টোটো ওয়ালা, বাড়িটা পর্যন্ত আসে নি, একশো মিটার আগেই নামিয়ে দিয়েছে। অগত্যা পায়ে হেঁটেই এগিয়ে চললাম বাড়ি টা পর্যন্ত। সামনে এসে বাড়ি টাকে দেখেই যেন গা ছম ছম করে উঠলো। চারি দিকে লতানো গুল্ম বাড়ি টাকে পুরো বেষ্টন করে রেখেছে, মোটা মোটা কাঁথের দেয়াল, একটা দেয়ালে আবার অনেক বড় ফাট ধরেছে, তার মধ্যে মাকড়শা সংসার পেতে বসেছে। ভেতরে নিকষ অন্ধকার, নিজের হাত কেও ঠাওর করা মুশকিল হচ্ছে, গোটা পাঁচেক বড় মোমবাতি আনা হয়েছিল, ওগুলো জ্বালা হলো। মোমবাতির আলোকেও যেন গ্রাস করে ফেলছে, এত অন্ধকার, সাথে একটা ভ্যাপসা গন্ধ। আমরা পলিথিন পেতে সবাই বসলাম। অমিত কে আজকে একটু অন্য রকম লাগছে, ছেলেটা এমনিতে খুব হাঁসি, খুশি আর কনফিডেন্ট ধরনের, আজকে কেমন যেন চিন্তিত আর চুপ চাপ মনে হচ্ছে। যেন বাড়ির পরিবেশ টার সাথে তাল মেলাতে চাইছে। বাইরে কোথাও বেড়াল কাঁদছে মনে হলো। সবাই বললাম, ভাই, কোথায় নিয়ে এলি ? এখানে রাত কাটানো তো নরকে রাত কাটানোর সমান। অমিত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, চিন্তা করিস না তোরা, আমি তো আছি। তোদের কিছু হতে দেবো না, আমি প্রমিস করছি। অমিত এর কথার ধরন টা আমার কেমন যেন লাগলো, যে ছেলে ভূত বা সুপার ন্যাচারাল কিছু বললে গর্জে উঠে বিজ্ঞানের তর্জমা শোনায়, সেই ছেলে আজকে বিরোধ করছে না, ঠাট্টা করছে না, কেমন যেনো অন্য অমিত লাগছে। অন্যদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে তারাও মনে মনে একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু কেউ অতটা আর আমল দিলাম না। বিপুল যে জায়গা তে বসে ছিল, তার মাথার ঠিক ওপরে, কাঠের বর্গা থেকে এক খণ্ড কাঠ ঝুলছে, মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে খসে পড়তে পারে, এই ভাবতে ভাবতেই , একটা খট করে আওয়াজের সাথে সাথেই কাঠের টুকরো টা বিপুল এর মাথা বরাবর খসে পড়ল, বিপুল রিয়াক্ট করার সময় না পেয়ে হাত দুটো মাথার ওপর তুলে কুঁকড়ে গেলো, যাক, কাঠের টুকরো টা, মাথায় পড়েনি, বিপুলের গা ঘেঁষে পাশে পড়েছে, মাথায় পড়লে, আজকে এখানেই বিপুলের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। কিন্তু আশ্চর্য হলো এই যে, কাঠ এর টুকরো টা, বিপুল এর মাথায় পড়ার কথা ছিল, গতিপথ পরিবর্তন হলো কি ভাবে ? হঠাৎ ই অন্ধকারে ঠাওর হলো, যে বিপুল এর ঠিক পেছনেই অমিত দাঁড়িয়ে আছে, নিজের কব্জি টা ধরে। বুঝলাম, অমিত ই হাত দিয়ে আটকে গতিপথ পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অমিত তো অনেক দূরে ছিল, এত তাড়াতাড়ি, বিপুলের পেছনে গেলো কি করে ? সে যাই হোক, অমিত চোট পেলো কিনা দেখা দরকার, আমি মোবাইল এর টর্চ টা জেলে অমিত এর হাতে ফেললাম, আর হাত টা ধরে বললাম দেখি, লেগেছে কোথায়? কিন্তু, ছ্যাঁত করে লাগলো, অমিত এর হাত টা বরফের মতো ঠান্ডা লাগলো, আমি বললাম, কি রে অমিত ? তোর হাত তো মরা লোকের মত ঠান্ডা, অমিত বলল, আর বলিস না, আজকে কি সব জড়ি বুটি দিয়ে বানানো তেল মাখতে হয়েছে, পেট গরম হয়েছিল বলে, দিদা জোর করে মাখালো, তার পরে পুরো বডি টেম্পারেচার যেন মাইনাস এ নেমে যেতে চায়। যাই হোক, আর কথা না বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও লেগেছে কিনা, কিন্তু নাহ, কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, ফোলা ও নেই। অমিত বলল, আরে, লাগেনি আমার, আমি হাতের তালু দিয়ে আটকেছিলাম, ওয়েট এর জন্য কব্জি তে একটু লেগেছিল, কিন্তু বেশি না। কথা শেষ হতে না হতেই, দরজা টা কি ভীষণ শব্দ করে খুলে গেলো, আর এক দমকা বাতাস যেন আছড়ে পড়ল ঘরটা তে, সব মোমবাতি নিভে গেলো। আমরা লাইটার হাতড়ে হাতড়ে আবার জ্বালালাম, দেখলাম অমিত নেই, রিয়াদ অমিত এর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে , অমিত সাড়া দিলো, আসছি ভাই, দাঁড়া, দরজার বাইরে থেকে গলা টা শোনা গেলো। অমিত ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, কি যে বিপদে ফেললাম ভাই তোদের, না আনলেই পারতাম, যে জিনিস দেখা যায়না, সেটা যেমন আছে বলা যায়না তেমন নেই বলেও বলা যায়না। আমারি ভুল ছিল। এই বিভীষিকার মধ্যে ও যেন আমরা বিজয় এর গর্বে আনন্দিত। এখন বাজে রাত নটা, অমিত বলল, দেখ ভূত প্রেত থাকুক বা না থাকুক, এখানে থাকা উচিত হবে না, বাড়িটার অবস্থা মোটেই ভালো না, তার ওপর সাপ খোপ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু না। চল বরং বাকি রাত টা আমরা স্টেশন এর ওয়েটিং রুম এ কাটিয়ে দি, ভোর ভোর তোরা রওনা হয়ে যাস, আমি মামার বাড়ি তে ফিরে যাবো, তোদের তুলে দিয়ে।

সবাই যে যার বজকা নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, মাইল খানেক হাঁটার পরে, একটা খালি টোটো কে পাওয়া গেলো। আমরা উঠে বসলাম। এটা ওটা টুক টাক আলাপ পরিচয়, প্রশ্ন উত্তর হতে হতে, টোটো ওয়ালা জিজ্ঞেস করলো, স্টেশন এর কাছে যে এক্সিডেন্ট টা হয়েছে, শুনেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু একটা অমনি অনুমান করেছিলাম, অনেক লোক জমেছিল। অমিত বলল ? কই না তো ? তুমি দেখেছ বা জানো কার হয়েছে ? টোটো ওয়ালা ইতস্তত করে বলল, না আমি দেখিনি, শুনলাম, কোনো একটা বছর ২৫ এর ছেলে, আত্মীয় বাড়ি তে বেড়াতে এসেছিল, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, ব্রেক ফেল করে নাকি সিধা ডিভাইডারে গিয়ে মেরেছে, ছেলে টা স্পট ডেড, দেখে কিছু বোঝা যাবে না, শুধু নাক আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে। লোকে বলছে জামার নীল রং টা সামনের দিকে পুরো লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবার চোখ অমিত এর জামার দিকে পড়ল, অমিত ও নীল জামা পরেছে, অমিত চোখ মুখ টা এমন করলো, যেন বলতে চাইছে, নীল জামা কি শুধু একটাই হয় নাকি ? আমরা স্ট্রেশন এর ওয়েটিং রুম এ বসে তাস খেলতে স্টার্ট করলাম। অমিত আমার পার্টনার হয়েছে, খেলতে খেলতে একটা জিনিষ আমাকে অবাক করে দিলো, অমিত যেন সবার মন পড়তে পারছে, সবার হাতের কার্ড দেখতে পাচ্ছে, যে কার্ড তার প্লে করার কোনো লজিক ই নেই, তেমন কার্ড প্লে করেও বেঁচে যাচ্ছে। আমারি ভালো, আমার পার্টনার, আমরা তো জিতছি।

পরের দিন সবাই ক্লাব এ আবার যথারীতি আড্ডা বসলো, আমরা কেউই সারাদিন পেপার পরি না, ক্লাবে এসে হেডলাইন গুলো একটু চোখ বুলিয়ে নিই, ইচ্ছে হলে। আজকে তাস খেলা স্টার্ট হয়নি এখনও, একটা পার্টনারের অভাব, আমি ততক্ষণে পেপার টাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি, একটা হেড লাইনে এসে চোখ টা আটকে গেলো, “বিভানগড় স্টেশান এর কাছে, পথ দুর্ঘটনায় এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু” একটা ছবি, তার নিচে লেখা, বয়স ২৫, নাম অমিত শাসমল। ক্লাব ঘরে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো, আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘ এর মতো। সব কিছু স্তব্ধ।

©ভূত
রহস্যময় সংঘাতটি আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে।
 
Top