কলকাতা, যা 'সিটি অফ জয়' এবং ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে পরিচিত, কেবল একটি শহর নয়—এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস, যা উপনিবেশিক শাসন, নবজাগরণ, এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু স্মৃতি বহন করে চলেছে। হুগলি নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত এই মহানগরীর ইতিহাস 17শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু হলেও, এর গুরুত্ব ও প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র উপমহাদেশে।
️ আদিপর্ব: তিনটি গ্রামের সম্মিলন
কলকাতার ইতিহাস মূলত তিনটি গ্রামীণ জনপদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়: সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা এবং গোবিন্দপুর। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে নিজেদের বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করতে আগ্রহী হয়। 1690 সালে, ইংরেজ বণিক ও প্রশাসক জব চার্নক (Job Charnock) সুতানুটিতে এসে একটি ব্রিটিশ কুঠি স্থাপন করেন, যা আনুষ্ঠানিকভাবে এই আধুনিক শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বার্ষিক মাত্র ₹3000 টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশরা এই তিনটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব লাভ করে। 1700 সালের মধ্যে, এই গ্রামগুলিকে একত্রিত করে ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে এবং তাদের প্রধান দুর্গ, ফোর্ট উইলিয়াম (Fort William), নির্মাণ করে। 1702 সালে এই স্থানের নামকরণ করা হয় ‘ক্যালকাটা’, যা ডিহি কলিকাতা গ্রামের নাম থেকেই উদ্ভূত।
উপনিবেশিক রাজধানী ও সংঘাতের যুগ
1756 সালে, বাংলার তৎকালীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ হয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেন। এই সময়কার বিখ্যাত ঘটনা হল 'ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি' বা অন্ধকূপ হত্যা। তবে, পরের বছরই (1757), রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এবং কলকাতা পুনরুদ্ধার করে। এই বিজয়ের ফলে বাংলায় ব্রিটিশদের রাজনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
1772 সালে, ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন এবং এটিকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে, কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর (লন্ডনের পর) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় থেকেই শহরটির ব্যাপক নাগরিক উন্নয়ন শুরু হয়। প্রাসাদোপম সরকারি ভবন, রাজপথ, পার্ক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে, যা শহরটিকে 'প্রসাদের শহর' (City of Palaces) উপাধি এনে দেয়।
বাংলার নবজাগরণ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
18শ ও 19শ শতকে কলকাতা কেবল ব্রিটিশ ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল না, এটি ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ সংস্কার এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এই শহর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসু, এবং স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্বরা এই সময়ে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় , এশিয়াটিক সোসাইটি, এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি জ্ঞান ও চেতনার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়কালে, কলকাতা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মঞ্চ হিসেবেও গড়ে ওঠে।
️ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজধানীর স্থানান্তর
বিশ শতকের শুরুতে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। 1905 সালের বঙ্গভঙ্গ এবং 1911 সালের বঙ্গভঙ্গ রদ—উভয় ক্ষেত্রেই কলকাতা রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে ছিল। এই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভূরাজনৈতিক কারণে, ব্রিটিশ সরকার 1911 সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরও, কলকাতা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব ধরে রাখে। এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, এবং অন্যান্য অনেক নেতার কর্মক্ষেত্র ছিল এই শহর।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কলকাতা
1947 সালে দেশভাগের সময়, কলকাতা গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সামাজিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়। স্বাধীনতার পর এটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 1950 এবং 1960 -এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) থেকে আগত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমনের ফলে শহরের জনমিতি এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক প্রাণবন্ততা নিয়ে কলকাতা আজও তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। পূর্বে 'ক্যালকাটা' নামে পরিচিত থাকলেও, 2001 সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শহরটির নাম পরিবর্তন করে 'কলকাতা' রাখা হয়। প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই মহানগরী আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কলমে - Aabheer এবং কিছু কিছু ইনফরমেশন গুগল থেকে নেওয়া
*Notification


️ আদিপর্ব: তিনটি গ্রামের সম্মিলন
কলকাতার ইতিহাস মূলত তিনটি গ্রামীণ জনপদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়: সুতানুটি, ডিহি কলিকাতা এবং গোবিন্দপুর। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে নিজেদের বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করতে আগ্রহী হয়। 1690 সালে, ইংরেজ বণিক ও প্রশাসক জব চার্নক (Job Charnock) সুতানুটিতে এসে একটি ব্রিটিশ কুঠি স্থাপন করেন, যা আনুষ্ঠানিকভাবে এই আধুনিক শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বার্ষিক মাত্র ₹3000 টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশরা এই তিনটি গ্রামের জমিদারি স্বত্ব লাভ করে। 1700 সালের মধ্যে, এই গ্রামগুলিকে একত্রিত করে ব্রিটিশরা তাদের বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলে এবং তাদের প্রধান দুর্গ, ফোর্ট উইলিয়াম (Fort William), নির্মাণ করে। 1702 সালে এই স্থানের নামকরণ করা হয় ‘ক্যালকাটা’, যা ডিহি কলিকাতা গ্রামের নাম থেকেই উদ্ভূত।
উপনিবেশিক রাজধানী ও সংঘাতের যুগ
1756 সালে, বাংলার তৎকালীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ হয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেন। এই সময়কার বিখ্যাত ঘটনা হল 'ব্ল্যাক হোল ট্র্যাজেডি' বা অন্ধকূপ হত্যা। তবে, পরের বছরই (1757), রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে এবং কলকাতা পুনরুদ্ধার করে। এই বিজয়ের ফলে বাংলায় ব্রিটিশদের রাজনৈতিক এবং সামরিক আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।
1772 সালে, ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতা থেকে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন এবং এটিকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীকালে, কলকাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর (লন্ডনের পর) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই সময় থেকেই শহরটির ব্যাপক নাগরিক উন্নয়ন শুরু হয়। প্রাসাদোপম সরকারি ভবন, রাজপথ, পার্ক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে, যা শহরটিকে 'প্রসাদের শহর' (City of Palaces) উপাধি এনে দেয়।
বাংলার নবজাগরণ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
18শ ও 19শ শতকে কলকাতা কেবল ব্রিটিশ ক্ষমতার কেন্দ্র ছিল না, এটি ছিল বাংলার নবজাগরণের প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সমাজ সংস্কার এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এই শহর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসু, এবং স্বামী বিবেকানন্দের মতো ব্যক্তিত্বরা এই সময়ে সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় , এশিয়াটিক সোসাইটি, এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলি জ্ঞান ও চেতনার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই সময়কালে, কলকাতা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মঞ্চ হিসেবেও গড়ে ওঠে।
️ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজধানীর স্থানান্তর
বিশ শতকের শুরুতে, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন এবং বিপ্লবী কার্যকলাপের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল কলকাতা। 1905 সালের বঙ্গভঙ্গ এবং 1911 সালের বঙ্গভঙ্গ রদ—উভয় ক্ষেত্রেই কলকাতা রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে ছিল। এই ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ভূরাজনৈতিক কারণে, ব্রিটিশ সরকার 1911 সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পরও, কলকাতা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার গুরুত্ব ধরে রাখে। এটি ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, এবং অন্যান্য অনেক নেতার কর্মক্ষেত্র ছিল এই শহর।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কলকাতা
1947 সালে দেশভাগের সময়, কলকাতা গুরুতর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সামাজিক অস্থিরতার সম্মুখীন হয়। স্বাধীনতার পর এটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। 1950 এবং 1960 -এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান (পরবর্তীকালে বাংলাদেশ) থেকে আগত বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর আগমনের ফলে শহরের জনমিতি এবং অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে।
ঐতিহ্য, বৈচিত্র্য এবং সাংস্কৃতিক প্রাণবন্ততা নিয়ে কলকাতা আজও তার স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। পূর্বে 'ক্যালকাটা' নামে পরিচিত থাকলেও, 2001 সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শহরটির নাম পরিবর্তন করে 'কলকাতা' রাখা হয়। প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়ে এই মহানগরী আজও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কলমে - Aabheer এবং কিছু কিছু ইনফরমেশন গুগল থেকে নেওয়া
*Notification

