পর্ব ৮
আমরা এখন গহন অরণ্যের পথে চলেছি। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে জিপটা হেলতে-দুলতে এগিয়ে চলছে, চারপাশে লাল মাটির ধুলো উড়ছে। ইন্দ্রদা মুখে একটা রুমাল চাপা দিয়ে বসে আছে। দূরে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা যায় ডাকবাংলোটা, মাথার ওপর বিশাল গাছ, সূর্যরশ্মি হাজার ছিদ্র হয়ে যেন চুইয়ে পড়ছে। আমাদের গাড়ির সামনের কাঁচটা ধুলোয় ঝাপসা হয়ে গেছে। আমরা নেমে পড়লাম।
রকমারি পাতা বেছানো পথ দিয়ে নিঃশব্দে তিনজনে এগিয়ে চললাম। শালপাতা, আম পাতা, দেবদারু পাতা, ইউক্যালিপটাস, জংলী কাঁটা পাতা আর তার উপর দিয়ে ডিগবাজি খেতে-খেতে উড়ে চলে নাম না জানা ফুলের ফিনফিনে পাপড়ি।
পরিত্যক্ত বাংলো বাড়িটার পাশে বিশাল বটবৃক্ষ, ভয়ংকর একটা সাপ গাছের কোটরে ঘোরাফেরা করছে। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে হালকা হিম-প্রবাহ বয়ে গেল। ভিজে ঘাসের ওপর দিয়ে এবার দরজার সামনে আসে পড়েছি। পায়ে একটা পিঁপড়ে কামড়াতেই দু আঙ্গুলের চাপে ওর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলাম। তখনই চোখে পড়ল মাটিতে কতগুলো অদ্ভুত পদচিহ্ন, হয়তো কোনো বন্য প্রাণীর হবে।
বাড়িটার মোটা গোল-গোল থাম ছাদের ভার বহন করছে। থামগুলোর গায়ে কারুকার্য বহুদিনের অবহেলায় বিবর্ণ রংচটা। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম নিঃসঙ্কোচে। ভেতরে নানান দামী আসবাব সাজানো, বেশ পরিষ্কার। এতদিনের পুরনো অট্টালিকায় কেউ বাস না করলে এত পরিষ্কার থাকা অসম্ভব। বিশাল জানলা দিয়ে বাইরে আলো-আঁধারি খেলায় রহস্যময় বনটা দেখা যায়। বাইরে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে জংলী কাঁটা-লতা এঁকে-বেঁকে উঠেছে, আর নিচে থোকা-থোকা ফুল। মাঝে-মাঝে শেয়ালের ডাক আসছিল। বাইরে টুকরো দৃশ্যপট, আর দেখা যায় বিশাল বাবলা গাছ, তফাতে সারি-সারি শাল আর দেবদারু গাছ।
বৈঠকখানাটা বেশ বড়, ছাদগুলো অস্বাভাবিক রকমের উঁচু। উপর থেকে বেলোয়ারী ঝাড়বাতি ঝুলছে। মেঝের পুরোটা মোজাইক করা। এক কোণে একটা ভাঙ্গা ড্রেসিং টেবিল, furniture গুলো পুরাতন হলেও যথেষ্ট মূল্যবান কাঠের। ঘরের একধারে দেয়াল ঘেঁসে একখানা তক্তপোষ, যাতে পুরু, দামী কার্পেট পাতা। এছাড়া রয়েছে আরও তিনটে ঘর, একটা তালাবন্ধ। মাঝে-মাঝে একটা বোঁটকা গন্ধ আসছিল; হয়তো ইঁদুর জাতীয় কিছু মরেছে।
বৈঠকখানায় সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে অন্য দুটো ঘরে ঢুকল ইন্দ্রদা আর সায়ন রায়। আমি ধুলোমাখা সোফাতেই ধপ করে বসে পড়লাম। দেওয়ালে নানা ভঙ্গিতে আঁকা মনুষ্য চিত্র; একটা, দুটো ভয়ংকর মুখোশ। সব থেকে নজর কাড়ে একটা স্তব্ধ দেওয়াল ঘড়ি, একেবারে দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটা। সেকেন্ডের কাঁটা নেই, আর কি করেই বা ঘড়িটা চলতো কে জানে; ব্যাটারি ভরার কোন জায়গা নেই। হয়তো sun clock জাতীয় কিছু একটা হবে।
ইন্দ্রদা পাশের ঘর থেকে একটা রংচটা ছেঁড়া মালা, কিছু পোড়া সিগারেট আর একটা কালো টুপি পেল। টুপির ভেতর থেকে দু-চারটা কাঁচাপাকা চুল আমি উদ্ধার করলাম।
ইন্সপেক্টর বললেন, "এরকম একটা মালা ভজহরিবাবুর গলায় ছিল না?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ। কিন্তু সেটা তো আসার সময় দেখে এলাম ওনার গলাতে তখনও অক্ষত রয়েছে।"
ইন্দ্রদা বলল, "উনি হয়তো এসেছিলেন, আকস্মিক কোনো ঘটনায় হয়তো গলার মালাটা ছিঁড়ে গেছে। তারপর নতুন একটা মালা তৈরি করে নেওয়া কিছুই অস্বাভাবিক নয়। May be but এ ব্যাপারে উনি যেন কিছু না জানতে পারেন।"
আমি বলে উঠলাম, "আর কাঁচাপাকা চুল তো ওনার হতেই পারে না। কারণ ওনার মাথা তো শুষ্ক মরূদ্যান।"
ইন্দ্রদা দৃষ্টি চলে গেছে তালাবন্ধ করা ঘরটার দিকে। তালাগুলো ঝুলে ভর্তি দেখে সহজেই বোঝা যায় বহুদিন এ ঘর খোলা হয় নি।
ইন্দ্রদা বলল, " কিন্তু দেখুন রায়বাবু তালার গর্তের কাছে যেখানে চাবি ঢোকানো হয় সেখানটা যথেষ্ট পরিষ্কার। আমি নিশ্চিত এই ঘরে ..."
"গুপ্তধন আছে!" ইন্সপেক্টরের চোখ জ্বলে উঠলো।
" না, অন্য কিছু। something secret."
" তাহলে আর কি? দুপুরে ভোজনের পর থানার লোকজন নিয়ে তালা ভেঙ্গে দেখা যাবে।"
"চলুন ফেরা যাক।"
আমরা জিপের দিকে এগুচ্ছি এমন সময় দূর থেকে মনে হল জিপের সামনে কালো চাদরে ঢাকা একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদেরকে দেখেই লোকটা থতমত খেয়ে পালাতে লাগলো। সায়ন রায় তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে রিভলভার বের করে গুলি চালালেন। কিন্তু ঘন বনের পাতার ফাঁকে নিমেষের মধ্যে লোকটা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমরা ছুটতে-ছুটতে এসে পড়েছি জিপের কাছে।
"Quick ইন্দ্রজিৎ বাবু ... ব্যাটা পালিয়ে যাবে কোথায়?"
পরবর্তী পর্ব খুব শীঘ্রই আসছে, সঙ্গে থাকুন, লেগে থাকুন
@Anshhi @Bhoot @Uronchondi @Babai_43 @Maity Adi @misstti @Ladywiththelamp @Ankita @ANNA007