- আমাদের ছবি গুলো দেবে তো?
- আমাদের কাছে কিন্তু টাকা নেই...
হঠাৎ করেই ওদের ভিডিও দেখে অসংখ্য স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। কুমোরটুলি ঘাট, গঙ্গার হওয়া আর একটা সন্ধে। আমার হাত শক্ত করে একজন ধরে আছে। আমি তার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে। আশা, আশঙ্কা, হারিয়ে ফেলার ভয়, হেরে যাওয়ার ভয় আমায় ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ক্রমাগত। আর একজন যেন আরো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরছে। সন্ধ্যা নেমেছে শহরে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। চোখের কোনে আসা জলকে হাত দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে আমার পাশের জন বলে উঠলেন...
- একদিন আমরা সফল হবো। সেইদিন কোনো নির্জন পাহাড়ের গ্রামে বসে খুব করে কাঁদবো জানিস। আমি কাঁদতে পারি না। কিন্তু তুই পাশে বসলেই আমার জমিয়ে রাখা কান্না গুলো বেরিয়ে আসতে চায়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম...
- ছেড়ে চলে যাবি না তো? আমি বেকার, তোর পরিবার মেনে নেবে?
- তুই আজ বেকার। কাল বেকার থাকবি এ কথা ভাবছিস কেন? আর শুধু তোর ওপর তো আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নয়। কী জন্য দিন রাত লেগে আছি? পড়াশোনা করছি?
- বড়ো ভয় হয়। হারিয়ে ফেলার। আমার ছোটবেলা তুই জানিস। আমি শুধু ছোটো থেকে কাউকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি।
- আমি আছি তো, আমিই থাকবো।
রাত বাড়ছিল। আমরা চুপ করে বসে ছিলাম। একটু দূরেই গিটার বাজিয়ে অনেকেই গান গাইছিল। আমরা শুনছিলাম।
মুমু। আমার মতো চাতক পাখির জীবনে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। কিভাবে আমার মতো একজনকে তিনি পছন্দ করেছিলেন তার উত্তর আজও তিনি আমায় দেননি বা বলতে গেলে আমিও আর খোঁজ করিনি। কলেজ পাশ করে দ্বিধায় ভুগছি মাস্টার্স করবো নাকি সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা। বাড়ির অবস্থা টালমাটাল। বাবার চাকরির আজ আছে কাল নেই। তাও বাবা বলছে আরেকটু চেষ্টা কর তুই পারবি। মনের হতাশা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমায়। ঠিক তখনই আমার জীবনে তাঁর প্রবেশ। আমার ঘরে লাফিং বুদ্ধ রাখবেন তিনি, চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি থাকলেও তিনি রান্না করবেন আমার জন্য চিংড়ি মাছ। দেওয়ালের রঙের সাথে ম্যাচ করে পর্দা কিনবেন আরো কত কী। আমি তখনো দ্বিধায়। এটাই কী প্রেম? নাকি আবার ভুল করতে চলেছি? কিন্তু সেই বিচার বিবেচনা করার আগেই আমার জন্মদিনের দিন রাত বারোটায় একটা দীর্ঘ মেসেজ। সেই মেসেজ জানান দিচ্ছে, "আমি তোমায় ভালবাসি, তুমি না বাসলেও আমি বাসি।" আদর, ভালোবাসা পেতে কে না চায়। ছেঁড়া চাদরে শুয়েই তো আমরা লাখ টাকার স্বপ্ন দেখি। তারপর ভিক্টোরিয়া। একজন হাত শক্ত করে ধরলো। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা কথারা প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ পেলো। আমরাও এগিয়ে চললাম সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। তুমি থেকে তুই। ভালবাসি থেকে হতচ্ছাড়াতে ট্রান্সফার হতে সময় লাগলো বড়োই কম। ওই যে আমাদের কী আর সুখ বেশিদিন সহ্য হয়। কিন্তু ম্যাডামের ইচ্ছাশক্তির জোরের কাছে বারবার পরাজিত হয়েছি আমি। আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা। প্রতিমাসে তখন মায়ের জন্য প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার একটা ইনজেকশন লাগে। আমি মোটে কয়েকটা টিউশনি করি। মানুষের থেকে সাহায্য নিয়ে কোনো রকমে চলছে মায়ের চিকিৎসা। টোটোতে পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য বেশ খানিকটা হেঁটে যাই। এমনি একদিন, সম্ভবত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, আমি সাঁতরাগাছি স্টেশনে বসে আছি। মানি ব্যাগে যা আছে সেটা পরের দিনের টোটো ভাড়া। সকাল থেকে সেইভাবে খাওয়া নেই। ব্যাংকে যা আছে তাই দিয়ে মাসের শেষে মায়ের ইনজেকশন আর ওষুধ আসবে। খিদেতে ছটফট করছি কিন্তু খাবার পয়সা নেই। রাতের দিকে পড়িয়ে ফেরার সময় আমি মুমুকে ফোন করতাম। কিছুক্ষণ কথা বলতাম তারপর রেখে দিতাম। ওটাই যেনো আমায় অনেকটা শক্তি দিতো। তেমনি মুমু ফোন করেছে...
- কিরে কোথায়?
- এই তো সাঁতরাগাছি...
- কিছু খেয়েছিস?
- হ্যাঁ ওই চা বিস্কুট দিয়েছিল সেটাই।
- তার মানে সন্ধ্যে থেকে কিছু পেটে পড়েনি তাই তো?
- না।
- না খেয়ে সব কাজে জিতে জেতে পারবি তো?
- আসলে মানে...
- খেয়ে নে। আমি ফোন রাখছি।
ফোন রাখার সাথে সাথে গুগল পে তে একশো টাকা ঢুকলো। হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ।
- ধার দিলাম। যেদিন চাকরি পাবি, সুদ সমেত ফেরত দিবি। অনেকদিন হয়েছে অনি, আমি বুঝি। এইটুকু সামর্থ্য আমার আছে। অন্তত মুখ ফুটে বল। আমি যেমন আবদার করি তোর কাছে এইটুকু আবদার করতেই পারিস তুই। এতে তুই ছোটো হয়ে যাবি না। খেয়ে নে, না খেয়ে শরীর খারাপ করবে।
আমি চুপ করে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টা খুব খেলো, নগণ্য, হাসির। হতেই পারে। আমি তো এমন ভাবেই আগলে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি তো চেয়েছিলাম এমনি একটা আশ্রয়, এমনি এক চিলেকোঠা। যেখানে আমি না বললেও আমার কথা কেউ বুঝবে। কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজের থেকেও বেশি উল্টো দিকের মানুষটাকে ভালোবাসে। এরা আগলে রাখতে জানে, নিজের অধিকার বুঝে নিতে বা বুঝিয়ে দিতে জানে। এদের চোখে শাসনের সাথে ভালোবাসা ও মিশে থাকে। বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর মুমুর ওপর চাপ বাড়লো। কিন্তু কিছু মানুষ বড়ো জেদি হয়। আমার বাড়িতে এসব নিয়ে কোনোদিন মা বাবা মাথায় ঘামায়নি। উল্টে আমার ভাবনার বাইরে গিয়ে তারা মুমুকে বড়ো ভালোবাসে। মুমু আমার বাড়ি, আমার ঘরকে নিজের ঘর মনে করত সেই সময়। মনে পড়ে এক দুপুরের কথা। সেইদিন আমার ভীষন জ্বর। দুপুর বেলা মুমুকে শুধু জানাতে পেরেছিলাম...
- আমার না খুব জ্বর। আমি একটু ঘুমোতে গেলাম।
বিকালে যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম একজন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম চোখেই দেখলাম ম্যাডাম আমার মাথার কাছে বসে আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। কখন এসেছেন জানি না। কেউ কেউ ভাবছেন হয়তো এত গুল মারছে বাপরে, গল্পের গরু গাছে ওঠে। আসলে কিছু কিছু ঘটনা এমনি ঘটে যা বাস্তবের সাথে মেলানো বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই চমকে উঠে বসলাম।
- বাবা কী নাক ডাকিস রে অনি। পরে রাতেও এমন নাক ডাকবি আর আমার ঘুমের দফা রফা হবে। এই তোকে না হঠাৎ খুব মিষ্টি দেখতে লাগছে।
আমি নির্বাক। শুধু ভাবছি ওপরওলা আমার ওপর সত্যিই এত প্রসন্ন? হয়তো। প্রতিবার অষ্টমীতে পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলী দিই। সেবার পুজোর কয়েকদিন আগেই ম্যাডাম হাজির হলেন আমার বাড়ি। তারপর ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে হুকুম দিলেন...
- এটা পরে আয় তো একবার দেখি কেমন লাগছে তোকে দেখতে।
ভাবনার অবকাশ পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আরেকপ্রস্থ বকুনি খেলাম। তারপর ঘরে ঢুকে প্যাকেট খুলতেই বেরোলো এক পাঞ্জাবি। ফেব্রিকের কাজ করা। ম্যাডাম নিজেই তৈরি করেছেন। অবাক হয়ে কাজ দেখবো কী তার আগেই...
- একটা পাঞ্জাবি পরতে এত সময় লাগে?
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম মা আর ম্যাডাম দুজনেই হাজির। মা পাঞ্জাবির কাজ দেখে মুমুর গাল টিপে দিয়ে বলল, "বড়ো ভালো হয়েছে রে, কী সুন্দর দেখাচ্ছে।" এখনো পাঞ্জাবিটা আছে আমার কাছে।
জন্মদিনের গিফট হিসাবে প্রতিবছর একটা কেক আমি কাটি। সেটা মুমুর দেওয়া। ওই নিয়ে আসে। সাজিয়ে গুছিয়ে আমায় বসতে বলে। বহুবছর ধরে এই রীতি পালন হচ্ছে। মায়ের হাতের পায়েস আর মুমুর নিয়ে আসা কেক এটাই আমার জন্মদিনের উপহার।
- "চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো..."
উল্টো দিক থেকে একটা ফোঁপানোর আওয়াজ শুধু পেলাম। আমি মুমু, মুমু বলে ডাকছি তখন...
- বিকালে দেখা কর।
ফোন কেটে গেলো। আমি বিকালের অপেক্ষায় কাটিয়ে দিলাম। বিকাল হতেই পছন্দের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম দুর থেকে একটা একজন আসছে। এ চলন আমার বড়ো চেনা। আসছে না দৌড়াচ্ছে। ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।
আমায় যখন ছাড়লো দেখলাম আমার কাঁধের অংশটা ভিজে গেছে। চোখের কাজলটা গালে নেমে এসেছে। আমরা পাহাড়ের কোলে এক গ্রামে গিয়েছি। অনেকক্ষণ কেঁদেছি। ঝগড়া করেছি, কাছে এসেছি আবার অভিমান করে কথা বলা বন্ধ রেখেছি। এই ভিডিওটা মুমু'ই আমায় পাঠিয়েছিল। ভিডিওর তলায় লেখা ছিল, "আজকাল আমায় আর তুই ফুল কিনে দিস না। বিয়ের পর কী বউকে ফুল কিনে দিতে নেই?"
হ্যাঁ, ম্যাডাম আমায় আর ছাড়েননি। নিজেও একটি ভালো চাকরি জোগাড় করলেন। তারপর বললেন, "ইহ জীবনে তোমায় আর ছাড়ছি না। ওই যে কথা দিয়েছিলাম আমি থাকবো, আমিই থাকবো।"
শুধু আশা করবো ওরাও যেন এইভাবেই বেঁধে বেঁধে থাকে। ভালো থাকে, ভালোবাসায় থাকে। ব্যাস এইটুকু।
বি দ্রঃ-লেখাটির কিছু কিছু অংশ সংগৃহীত
*Notification
@Ankita @Illusion @subsar @Sumannnn @Tiktiki @mou4 @Oishi @Uronchondi @Sherl0ck @Bhoot
- আমাদের কাছে কিন্তু টাকা নেই...
হঠাৎ করেই ওদের ভিডিও দেখে অসংখ্য স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যেতে শুরু করলাম। কুমোরটুলি ঘাট, গঙ্গার হওয়া আর একটা সন্ধে। আমার হাত শক্ত করে একজন ধরে আছে। আমি তার কাঁধে মাথা দিয়ে বসে। আশা, আশঙ্কা, হারিয়ে ফেলার ভয়, হেরে যাওয়ার ভয় আমায় ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলছে ক্রমাগত। আর একজন যেন আরো শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরছে। সন্ধ্যা নেমেছে শহরে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁটা রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। চোখের কোনে আসা জলকে হাত দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে আমার পাশের জন বলে উঠলেন...
- একদিন আমরা সফল হবো। সেইদিন কোনো নির্জন পাহাড়ের গ্রামে বসে খুব করে কাঁদবো জানিস। আমি কাঁদতে পারি না। কিন্তু তুই পাশে বসলেই আমার জমিয়ে রাখা কান্না গুলো বেরিয়ে আসতে চায়।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম...
- ছেড়ে চলে যাবি না তো? আমি বেকার, তোর পরিবার মেনে নেবে?
- তুই আজ বেকার। কাল বেকার থাকবি এ কথা ভাবছিস কেন? আর শুধু তোর ওপর তো আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নয়। কী জন্য দিন রাত লেগে আছি? পড়াশোনা করছি?
- বড়ো ভয় হয়। হারিয়ে ফেলার। আমার ছোটবেলা তুই জানিস। আমি শুধু ছোটো থেকে কাউকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি।
- আমি আছি তো, আমিই থাকবো।
রাত বাড়ছিল। আমরা চুপ করে বসে ছিলাম। একটু দূরেই গিটার বাজিয়ে অনেকেই গান গাইছিল। আমরা শুনছিলাম।
মুমু। আমার মতো চাতক পাখির জীবনে বর্ষার প্রথম বৃষ্টি। কিভাবে আমার মতো একজনকে তিনি পছন্দ করেছিলেন তার উত্তর আজও তিনি আমায় দেননি বা বলতে গেলে আমিও আর খোঁজ করিনি। কলেজ পাশ করে দ্বিধায় ভুগছি মাস্টার্স করবো নাকি সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা। বাড়ির অবস্থা টালমাটাল। বাবার চাকরির আজ আছে কাল নেই। তাও বাবা বলছে আরেকটু চেষ্টা কর তুই পারবি। মনের হতাশা ধীরে ধীরে গ্রাস করছে আমায়। ঠিক তখনই আমার জীবনে তাঁর প্রবেশ। আমার ঘরে লাফিং বুদ্ধ রাখবেন তিনি, চিংড়ি মাছে অ্যালার্জি থাকলেও তিনি রান্না করবেন আমার জন্য চিংড়ি মাছ। দেওয়ালের রঙের সাথে ম্যাচ করে পর্দা কিনবেন আরো কত কী। আমি তখনো দ্বিধায়। এটাই কী প্রেম? নাকি আবার ভুল করতে চলেছি? কিন্তু সেই বিচার বিবেচনা করার আগেই আমার জন্মদিনের দিন রাত বারোটায় একটা দীর্ঘ মেসেজ। সেই মেসেজ জানান দিচ্ছে, "আমি তোমায় ভালবাসি, তুমি না বাসলেও আমি বাসি।" আদর, ভালোবাসা পেতে কে না চায়। ছেঁড়া চাদরে শুয়েই তো আমরা লাখ টাকার স্বপ্ন দেখি। তারপর ভিক্টোরিয়া। একজন হাত শক্ত করে ধরলো। অনেকদিনের জমিয়ে রাখা কথারা প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ পেলো। আমরাও এগিয়ে চললাম সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। তুমি থেকে তুই। ভালবাসি থেকে হতচ্ছাড়াতে ট্রান্সফার হতে সময় লাগলো বড়োই কম। ওই যে আমাদের কী আর সুখ বেশিদিন সহ্য হয়। কিন্তু ম্যাডামের ইচ্ছাশক্তির জোরের কাছে বারবার পরাজিত হয়েছি আমি। আজও মনে পড়ে সেই দিনের কথা। প্রতিমাসে তখন মায়ের জন্য প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার একটা ইনজেকশন লাগে। আমি মোটে কয়েকটা টিউশনি করি। মানুষের থেকে সাহায্য নিয়ে কোনো রকমে চলছে মায়ের চিকিৎসা। টোটোতে পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য বেশ খানিকটা হেঁটে যাই। এমনি একদিন, সম্ভবত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি, আমি সাঁতরাগাছি স্টেশনে বসে আছি। মানি ব্যাগে যা আছে সেটা পরের দিনের টোটো ভাড়া। সকাল থেকে সেইভাবে খাওয়া নেই। ব্যাংকে যা আছে তাই দিয়ে মাসের শেষে মায়ের ইনজেকশন আর ওষুধ আসবে। খিদেতে ছটফট করছি কিন্তু খাবার পয়সা নেই। রাতের দিকে পড়িয়ে ফেরার সময় আমি মুমুকে ফোন করতাম। কিছুক্ষণ কথা বলতাম তারপর রেখে দিতাম। ওটাই যেনো আমায় অনেকটা শক্তি দিতো। তেমনি মুমু ফোন করেছে...
- কিরে কোথায়?
- এই তো সাঁতরাগাছি...
- কিছু খেয়েছিস?
- হ্যাঁ ওই চা বিস্কুট দিয়েছিল সেটাই।
- তার মানে সন্ধ্যে থেকে কিছু পেটে পড়েনি তাই তো?
- না।
- না খেয়ে সব কাজে জিতে জেতে পারবি তো?
- আসলে মানে...
- খেয়ে নে। আমি ফোন রাখছি।
ফোন রাখার সাথে সাথে গুগল পে তে একশো টাকা ঢুকলো। হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ।
- ধার দিলাম। যেদিন চাকরি পাবি, সুদ সমেত ফেরত দিবি। অনেকদিন হয়েছে অনি, আমি বুঝি। এইটুকু সামর্থ্য আমার আছে। অন্তত মুখ ফুটে বল। আমি যেমন আবদার করি তোর কাছে এইটুকু আবদার করতেই পারিস তুই। এতে তুই ছোটো হয়ে যাবি না। খেয়ে নে, না খেয়ে শরীর খারাপ করবে।
আমি চুপ করে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টা খুব খেলো, নগণ্য, হাসির। হতেই পারে। আমি তো এমন ভাবেই আগলে থাকতে চেয়েছিলাম। আমি তো চেয়েছিলাম এমনি একটা আশ্রয়, এমনি এক চিলেকোঠা। যেখানে আমি না বললেও আমার কথা কেউ বুঝবে। কিছু মানুষ থাকে, যারা নিজের থেকেও বেশি উল্টো দিকের মানুষটাকে ভালোবাসে। এরা আগলে রাখতে জানে, নিজের অধিকার বুঝে নিতে বা বুঝিয়ে দিতে জানে। এদের চোখে শাসনের সাথে ভালোবাসা ও মিশে থাকে। বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পর মুমুর ওপর চাপ বাড়লো। কিন্তু কিছু মানুষ বড়ো জেদি হয়। আমার বাড়িতে এসব নিয়ে কোনোদিন মা বাবা মাথায় ঘামায়নি। উল্টে আমার ভাবনার বাইরে গিয়ে তারা মুমুকে বড়ো ভালোবাসে। মুমু আমার বাড়ি, আমার ঘরকে নিজের ঘর মনে করত সেই সময়। মনে পড়ে এক দুপুরের কথা। সেইদিন আমার ভীষন জ্বর। দুপুর বেলা মুমুকে শুধু জানাতে পেরেছিলাম...
- আমার না খুব জ্বর। আমি একটু ঘুমোতে গেলাম।
বিকালে যখন ঘুম ভাঙলো দেখলাম একজন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘুম চোখেই দেখলাম ম্যাডাম আমার মাথার কাছে বসে আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। কখন এসেছেন জানি না। কেউ কেউ ভাবছেন হয়তো এত গুল মারছে বাপরে, গল্পের গরু গাছে ওঠে। আসলে কিছু কিছু ঘটনা এমনি ঘটে যা বাস্তবের সাথে মেলানো বড়ো কঠিন হয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই চমকে উঠে বসলাম।
- বাবা কী নাক ডাকিস রে অনি। পরে রাতেও এমন নাক ডাকবি আর আমার ঘুমের দফা রফা হবে। এই তোকে না হঠাৎ খুব মিষ্টি দেখতে লাগছে।
আমি নির্বাক। শুধু ভাবছি ওপরওলা আমার ওপর সত্যিই এত প্রসন্ন? হয়তো। প্রতিবার অষ্টমীতে পাঞ্জাবি পরে অঞ্জলী দিই। সেবার পুজোর কয়েকদিন আগেই ম্যাডাম হাজির হলেন আমার বাড়ি। তারপর ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বার করে হুকুম দিলেন...
- এটা পরে আয় তো একবার দেখি কেমন লাগছে তোকে দেখতে।
ভাবনার অবকাশ পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আরেকপ্রস্থ বকুনি খেলাম। তারপর ঘরে ঢুকে প্যাকেট খুলতেই বেরোলো এক পাঞ্জাবি। ফেব্রিকের কাজ করা। ম্যাডাম নিজেই তৈরি করেছেন। অবাক হয়ে কাজ দেখবো কী তার আগেই...
- একটা পাঞ্জাবি পরতে এত সময় লাগে?
পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম মা আর ম্যাডাম দুজনেই হাজির। মা পাঞ্জাবির কাজ দেখে মুমুর গাল টিপে দিয়ে বলল, "বড়ো ভালো হয়েছে রে, কী সুন্দর দেখাচ্ছে।" এখনো পাঞ্জাবিটা আছে আমার কাছে।
জন্মদিনের গিফট হিসাবে প্রতিবছর একটা কেক আমি কাটি। সেটা মুমুর দেওয়া। ওই নিয়ে আসে। সাজিয়ে গুছিয়ে আমায় বসতে বলে। বহুবছর ধরে এই রীতি পালন হচ্ছে। মায়ের হাতের পায়েস আর মুমুর নিয়ে আসা কেক এটাই আমার জন্মদিনের উপহার।
- "চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা শুনছো..."
উল্টো দিক থেকে একটা ফোঁপানোর আওয়াজ শুধু পেলাম। আমি মুমু, মুমু বলে ডাকছি তখন...
- বিকালে দেখা কর।
ফোন কেটে গেলো। আমি বিকালের অপেক্ষায় কাটিয়ে দিলাম। বিকাল হতেই পছন্দের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম দুর থেকে একটা একজন আসছে। এ চলন আমার বড়ো চেনা। আসছে না দৌড়াচ্ছে। ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।
আমায় যখন ছাড়লো দেখলাম আমার কাঁধের অংশটা ভিজে গেছে। চোখের কাজলটা গালে নেমে এসেছে। আমরা পাহাড়ের কোলে এক গ্রামে গিয়েছি। অনেকক্ষণ কেঁদেছি। ঝগড়া করেছি, কাছে এসেছি আবার অভিমান করে কথা বলা বন্ধ রেখেছি। এই ভিডিওটা মুমু'ই আমায় পাঠিয়েছিল। ভিডিওর তলায় লেখা ছিল, "আজকাল আমায় আর তুই ফুল কিনে দিস না। বিয়ের পর কী বউকে ফুল কিনে দিতে নেই?"
হ্যাঁ, ম্যাডাম আমায় আর ছাড়েননি। নিজেও একটি ভালো চাকরি জোগাড় করলেন। তারপর বললেন, "ইহ জীবনে তোমায় আর ছাড়ছি না। ওই যে কথা দিয়েছিলাম আমি থাকবো, আমিই থাকবো।"
শুধু আশা করবো ওরাও যেন এইভাবেই বেঁধে বেঁধে থাকে। ভালো থাকে, ভালোবাসায় থাকে। ব্যাস এইটুকু।
বি দ্রঃ-লেখাটির কিছু কিছু অংশ সংগৃহীত
*Notification

@Ankita @Illusion @subsar @Sumannnn @Tiktiki @mou4 @Oishi @Uronchondi @Sherl0ck @Bhoot





